ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর

নূরুদ্দীন দরজী:

মাত্র ১৮/২০ বছর আগের কথা। চাকরি করি নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলায়। পরিদর্শনে গিয়েছি উপজেলার প্রায় দক্ষিণ প্রান্তে ইসলামপুর স্কুলে। বর্ষাকাল। উত্তরমুখী স্কুলের অফিস কক্ষে বসে প্রশাসনিক দিকগুলো নিরীক্ষণ করছি। এর‌ই মধ্যে শুনতে পাই ওয়াল ঘেষা খরাজালে মাছ ধরার শব্দ, জেলে ভাইদের উচ্ছ্বাস-আনন্দ। জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি সুন্দর খরাজাল ও জালের সম্মুখ ভাগে বিশেষ পদ্ধতিতে পানিতে রাখা মাছ লাফালাফি করছে। অন্য মাছ তেমন নেই শুধুই ইলিশ। স্কুলটি থেকে মেঘনা নদীর দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। কিন্তু নদী বরাবর নিচু জমি থাকায় ইলিশগুলো চলে এসেছে এখানে সহজেই। পরিদর্শন সংক্রান্ত কাজ শেষে বের হয়ে খরার কাছে যাই এবং ইলিশের খেলাচ্ছলে লাফ ঝাফ দেখে নয়ন জুড়িয়ে যায়। জিজ্ঞেস করি, মাছ বিক্রি করবেন? খরা থেকে উত্তর আসে নিতে পারেন। সাথের শিক্ষকগণ তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয়ের পর আমার বাড়ি নরসিংদী জেনে বলেন, স্যার, আপনার জন্য ১২০ টাকা কেজি-অন্যদের জন্য ১৫০ টাকা। কথা না বাড়িয়ে ৫ কেজি তাজা লাফঝোপ করা ইলিশ নেই। মাপঝোপের পর একটি মাছ বেশি দিয়ে বলেন, এটি আপনার সম্মানে। সপ্তাহের শেষ দিন হ‌ওয়ায় মাছগুলো নিয়ে আড়াইহাজার,মাধবদী ও নরসিংদী হয়ে শিবপুরে বাড়ি চলে আসি। বাড়ির মানুষজন দেখে খুব‌ই খুশী হয়। তখনো দেখছিলাম ইলিশগুলো যেন লাফাচ্ছে।
আমার স্পট মনে পড়ে, জীবনে অনেক দিন মাছ কিনতে বাজারে গিয়ে খালি ব্যাগ নিয়ে ফেরত এসেছি। কারণ,সেদিন বাজারে ইলিশ ছাড়া অন্য কোন মাছ ছিলনা। ইলিশ খেতে খেতে বিরক্তি ও অরুচি হ‌ওয়ায় সেই করতে হয়েছে। আবার যখন একা বাসায় থাকতাম, তখন অনিচ্ছা হলেও ইলিল‌ই ছিল আর্শীবাদ। মাছ কাটতে ধুঁইতে তেমন পারতাম না বলে আট আনা বা এক টাকায় কেটে ভাগ দেওয়া এক ভাগ ইলিশ নিয়ে এসে সহজে রান্না করতে পারতাম। বাজার থেকে ইলিশ মাছ বার বার আনার কারণে গৃহিনী ঝগড়া করেছে এমন অনেক মধুর স্মৃতি আজকাল ইলিশ দেখলেই মনে পড়ে। বাড়ির তরকারি রান্না করার পাতিলগুলো কলপার নিয়ে সাবান ও ছাই দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করা হতো ইলিশের গন্ধ দূর করার জন্য। শুধুই ইলিশের তরকারি থাকায় অনেক দিন বা রাতে না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আমার অনেক। ইলিশ মাছ যারা বেশি বেশি খায় তাদের অন্য ভাবে বিবেচনা করা হতো। অযথাই বলা হতো ইলিশ বেশি খেলে বাত রোগ হয়।
আজকাল বলা হয়ে থাকে “ইলিশ স্বর্ণের দাম,। চাইল‌েই ইলিশ পাওয়া যায়না। সব বাজারে এ মাছ বিক্রি হয়না। ইলিশের বাজার এখন অনেক বড় বাজার। ইলিশ কিনতে হলে পূর্বে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। দামাদামি করা যায় না। বিক্রেতা যে দাম হাকায় সে দামেই কিনতে হয়। ইলিশ বিক্রেতাকে মনে হয় অভিজাত শ্রেণির লোক। অপেক্ষাকৃত গরিব মানুষ ইচ্ছে করলেই ইলিশ খেতে পারেন না। পহেলা বৈশাখে বাজারে ইলিশ খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর বলা হলে ও খোদ চাঁদপুরেই তিন বছর আগে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রুই মাছ দিয়ে পান্তা খেয়েছিলাম।
যত কথাই বলি – ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এ মাছের জন্য বাঙালি গর্ববোধ করে। আমাদের মাছের চাহিদার এক দশমাংশ ইলিশ থেকে মিটে। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬৫% ভাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ১৫% ভাগ ভারত, ১০% ভাগ মিয়ানমার এবং ১০% ভাগ আটলান্টিক ও আরব সাগর তীরবর্তী দেশে হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ইলিশ ধরা ও ব্যবসার সাথে জড়িত। ইলিশ গভীর পানির মাছ হলেও জীবনের একটি সময় কাটায় আমাদের চাঁদপুরের মেঘনায়। অর্থাৎ ডিম ছাড়ার সময় সমুদ্রের প্রচন্ড ঢেউয়ে সমস্যা হ‌ওয়ায় বোধ হয় এরা নিরাপদ মেঘনায় আসে।
ইলিশ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে প্রথম। জাতীয় এ সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে আমাদের সরকার যতেষ্ট তৎপর। জাটকা অর্থাৎ পোনা ইলিশ নিধনে দেশের প্রচুর ক্ষতি হয়। পোনা ইলিশ ধরবো না,জাতীয় সম্পদ নষ্ট করবো না। এগিয়ে যাওয়ার এমন শ্লোগান যদি হয় আমাদের অঙ্গীকার অবশ্য‌ই ইলিশ প্রাচুর্যে ভরে থাকবে বাংলাদেশ। লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও) ও উপদেষ্টা, দৈনিক নরসিংদীর নবকণ্ঠ

সংবাদটি সর্বমোট 1,261 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *