অকালে বোধিতা দেবী দুর্গা

॥ মধু সুদন দাস ॥
চন্ডীতে কথিত আছে পুরাকালে রাজা সুরথ শত্রু কর্তৃক পরাজিত এবং অমাত্যগণ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে মনের দুঃখে গভীর অরন্যে গমন করেন। সেই সময়ে বৈশ্য সমাধি অসাধু স্ত্রী-পুত্রের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে সংসার ত্যাগ করে সেই বনে এসে আত্ম গোপন করেন। সুরথ রাজার আকাংখা তার হারানো রাজ্য লাভ আর বৈশ্যের আকাংখা পরিবার পরিজনের মোহ ও অশান্তি থেকে মুক্তিলাভ । তারা দুজনেই বনের মাঝে মেধস মুনির আশ্রমে গেলেন এবং উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। মেধস মুনি তাদেরকে দেবী মহামায়ার পূজার করার জন্য পরামর্শ দেন এবং দেবীর স্বরূপ বর্ননা করতে গিয়ে মধুকৈটভ মহিষাসুর শুম্ভ নিশুম্বকে কিভাবে বিনাশ করেছিলেন সেই কাহিনী শুনান । অবশেষে রাজা সুরখ ও বৈশ্য সমাধি নদীরতীরে
মাটির প্রতিমা তৈরি করে বসন্তকালে দূর্গা পূজা করেছিলেন বলে কথিত আছে। কিন্ত বর্তমানে আমরা যে দুর্গা পূজা করে থাকি তা হলো শরৎকাল । শরৎকালে পূজা কিভাবে হলো তা বিশ্লেষণ করলে শ্রীশ্রী চন্ডী মন্ত্রে আমরা পাই “রাবণস্য বিনাশায় রামাস্যানুগ্রাহায় চ অকালে বোধিতা দেবী ”। অর্থাৎ রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্র কর্তৃক অকালে দেবীর বোধন করতে হয়েছিল।
মানুষ ১২ ঘন্টায় দিন এবং ১২ঘন্টায় রাত। অপর পক্ষে দেবপক্ষের ৬ মাস দিন এবং ৬মাস রাত । অর্থাৎ মাঘ মাস হতে আষাঢ় মাস পর্যন্ত দিন এবং শ্রাবণ মাস হতে পৌষ মাস পর্যন্ত রাত। দেবগনের দিনকে বলা উওরায়ণ এবং রাতকে বলা হয় দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ণে দেবগণ জাগ্রত এবং দক্ষিণায়নে নিদ্রিত থাকেন। শরৎকাল দক্ষিণায়নের অংশ। দেবী ভগবতী তখন নিদ্রিত সে জন্য তখন তাকে পুজার পূর্বে বোধন ও অধিবাসের প্রয়োজন হয়।
দেবী ভাগবত ও কালিকা পুরানের মতে অসময়ে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভংঙ্গ হলে দেবতারা শ্রীরামের মংগল চিন্তায় পদ্মযোনি ব্রহ্মার নিকট পরামর্শ চাইলেন। ব্রহ্মা বললেন “ আদ্যা শক্তির কৃপা ভিন্ন রাবন বধ সম্ভব নয়। কিন্তু দেবী তখন নিদ্রিত। তাকে প্রবোধিত করার জন্য ব্রহ্মা ও দেবগণ দেবীর স্তব করতে লাগলেন। স্তবে তুষ্ঠা হয়ে দেবী কুমারী মুর্তিতে আবির্ভূতা হলেন এবং বললেন, “ আপনারা কল্য বিল্বমূলে বোধন করবেন। আপনাদের প্রার্থনায় তিনি বোধিতা হবেন। জগন্মাতাকে প্রবুদ্ধ করে যথাবিধি অচনা করলে শ্রীরামচন্দ্রের কার্যসিদ্ধি হবে।” উল্লেখ্য দেবী দুর্গা কুমারী নামেও প্রসিদ্ধা। এজন্যই রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা করা হয়।
অতপর ব্রহ্মা মর্ত্যে এলেন এবং নির্জন স্থানে একটি বিল্ব বৃক্ষ দর্শন করলেন। তার সবুজ পত্ররাশির উপর এক মনোহারিনী বালিকা মূর্তি দর্শন করলেন। ইনিই জগজ্জননী এটা বিশেষভাবে অনুভব করে ব্রহ্মাদি দেবগণ বোধন স্তব করলে লাগলেন ” তুমি যে মহেশ্বরী আমরা নিশ্চিত রূপে জেনেছি। যেখানে শক্তির ক্রিয়া সকলই তোমার। আমরা কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করি সমগ্র শক্তি দিয়ে তুমি রামকে সাহায্য কর। জননী তুমি জাগরিতা হও, এজন্য বোধন করছি। “ তিনি তখন বালিকা মুর্তি ছেড়ে চন্ডিকারূপে নিজেকে ব্যক্ত করে বললেন, “ আমি সপ্তমি তিথিতে শ্রীরামচন্দ্রের দিব্য ধর্নুবানে প্রবেশ করব। অষ্টমী তিথিতে রাম রাবণের মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষনে রাবনের দশমাথা মাটিতে লুটাবে। দশমীতে শ্রীরামচন্দ্র বিজয় উৎসব করবে। ”
মহাশক্তির আবির্ভাবে শ্রীরামচন্দ্র অষ্টমী তিথিতে রাবণকে বধ করে প্রেম, ভক্তি রূপিনী সীতা দেবীকে উদ্ধার করলেন। মহাবিপদ কেটে গেল তাই তিথির নাম হলো মহাঅষ্টমী। মহা সম্পদ লাভ হলো বলে তিথির নাম হলো মহানবমী।
শ্রীরামচন্দ্রের এ দুর্গোৎসবের স্মরনেই আমাদের এই শারদীয় মহাপূর্জা। এই পূর্জার ভিতর দিয়ে মা দূর্গা সিদ্ধি, বল, বিদ্যা, সমৃদ্ধি দান করেন। এ জন্যই দেবীর সংগে সিদ্ধি, বল, বিদ্যা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে গনেশ, কার্ত্তিক, স্বরস্বর্তী ও লক্ষী দেবীকে দেখতে পাই। দেবী দুর্গা হাচ্ছেন শুভ শক্তির প্রতিক। তাই মা দুর্গার হাতে অসুর বিনাশের অর্থ মানুষের মন থেকে লোভ, কাম, হিংসা, ইত্যাদি অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটনো। -শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম, নরসিংদী।

সংবাদটি সর্বমোট 304 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *