অসম বিদ্যুৎ সরবরাহে সীমাহীন দুর্ভোগ

নূরুদ্দীন দরজী:
বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ ছাড়া কারো এক মুহূর্ত চলতে চায়না। বিদ্যুৎ ছাড়া সবকিছু অচল। পৃথিবীর এত যে উন্নতি ও সভ্যতা তার পিছনে সবচেয়ে অবদান বেশি বিদ্যুতের। বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন চলে না, কারখানার চাকা ঘুরে না, পাখা ঘুরে না, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শহর বন্দরে চলাফেরা করা যায়না । বর্তমানে শত সহস্র মাইল ও যোজন যোজন দূরত্বকে বিদ্যুৎ নিয়ে এসেছে অতি কাছে। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের সবকিছুই ঘরে বসে আমরা দেখতে পাই কেবলমাত্র বিদ্যুতের বদৌলতে‌। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিদ্যুৎ ব্যতীত প্রগতির যন্ত্র অবদান রাখতে পারে না। এক কথায় বলতে গেলে বিদ্যুৎ মানব সভ্যতার অগ্ৰগতির প্রধান হাতিয়ার।
-এই যে এত প্রয়োজনের বিদ্যুৎ, তা কিন্তু কেউ উদ্ভাবন করেননি। বিদ্যুৎ পৃথিবীতে আগেই ছিলো। যা উদ্ভাবন করা হয়েছে তা হচ্ছে পদ্ধতি। মাত্র কিছুদিন আগে প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিদ্যুৎ ব্যবহারের পদ্ধতি আবিস্কৃত হ‌ওয়ায় ক্রমান্বয়ে আকাশে চমকানো বিদ্যুতের যত‌ই এর প্রসার ঘটেছে। সারা পৃথিবীর উন্নয়নের নিয়ামকে পরিনত হয়েছে। প্রথম দেখা গিয়েছিলো পশমের উপর ঘষলে চমকানো কিছু পাওয়া যায়। চিন্তা করা হয়, কোন একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তু ঘষালে একটি আকর্ষণ ক্ষমতা আসে। ১৮০০ শতকে আমেরিকান মহান বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি উড়িয়ে ঘুড়ির সুতার সাথে তামার চাবি বেঁধে দিয়ে বজ্রপাতের সাথে আকর্ষণ বুঝতে পারেন। তাই তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মনোনিবেশ করেন। বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য তাঁর সমুদয় সম্পদ বিক্রি ও বিনিয়োগ করেন। এর পরে আর ও অনেক ঘটনা। ব্যাটারী আবিস্কৃত হয়। আবিস্কৃত হয় ডিসি ও এসি। হয় জেনারেটর ও মটর। ১৮৮৭ সালে নিকোলাস টেসলারের আবিস্কারের পথ ধরেই বর্তমান বিদ্যুতের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। প্রথম দিকে যদিও বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পৌছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মানবতাবাদীরা। এখন পয়সা দিয়ে ও মানুষ সেই বিদ্যুতের হয়রানিতে পড়তে হয়।
নানা আবিষ্কার ও ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়ার ব্যবস্থা হলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রারম্ভে, ১৯০১ সালে। ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর পুরাতন ঢাকায় বিদ্যুৎ বাতি জ্বলে উঠে। ওই সময় এ দেশের অনেক মানুষের জন্য‌ই বিদ্যুৎ পাওয়া ছিলো স্বপ্নের মত। তখন ছিলো ব্রিটিশ শোষণ শাসনের সময়। আসে পাকিস্তান। সে আমলে ও বিদ্যুৎ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করে। বিভিন্ন ভাবে এর ক্রমোন্নতি হয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। শ্লোগান ছিলো,” শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ,। তাঁর এ প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। আগের তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন বহুলাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলার ঘরে ঘরে আজ বিদ্যুৎ পৌছে গেছে। দুঃখজনক যে, করোনা ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটে বাংলাদেশের উৎপাদনে ও কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ও দেশ আবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য ও সরকার প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছে। নিসন্দেহে এর উন্নতি ও হবে।
বিদ্যুৎ বিতরণ বা ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের যে উদ্যোগ তাও সুন্দর। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কয়েকটি বিতরণ কতৃপক্ষ ও গ্রামাঞ্চলের জন্য প্রায় ৮০ টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে ভোক্তাদের মাঝে বিদ্যুৎ বিতরণের ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্ত আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করি প্রায় সময়‌ই পড়ে যাই বিপাকে। মাঝেমধ্যে ৮/১০ ঘন্টা বিদ্যুৎ পাই না। কেন এই অসম ব্যবস্থা- যেখানে শহর এলাকায় বলে কয়ে ২/১ ঘন্টা লোডশেডিং সেখানে গ্রামাঞ্চলে ১৫/২০ ঘন্টা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে থাকতে হচ্ছে। এখানে বিদ্যুৎ বিতরণকারীদের গাফিলতি ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হয়না। যদি ধরে নেই শহরের মানুষের বিদ্যুৎ ছাড়া খুবই সমস্যা ও কষ্ট হয়। এ জন্য শহরে একটু বেশি বিদ্যুত দিয়ে দিনে ২ ঘন্টা লোডশেডিং দিলে গ্ৰামে ৪ ঘন্টা বা ৬ ঘন্টা লোডশেডিং দেওয়া যায় । তা না করে গ্ৰামে সারা দিন ও সারা রাত বিদ্যুৎ থাকবে না এটি কেমন কথা? গত কদিন আগে আমাদের শিবপুর এলাকায় একদিন রাত ৭টা থেকে বিদ্যুৎ বিহীন পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত। এর‌ই মাঝে বিকেলে মাইকিং হচ্ছিল,”আগামী কাল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকবে না,। এমন আজব কান্ড অনেক সময়ই হয়। বিদ্যুতের ঘাটতি কি কেবল কোন বিশেষ গ্ৰাম এলাকার জন্য? যদি কোন জরুরি কারণে হয় আলাদা কথা। এ জন্য অসাধু কর্মচারীদের খামখেয়ালী ও উদাসিনতা দায়ী। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখলাম গত ১২ জুন/২০২৩ দেশে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিলো ২০% কম, অথচ সেদিন ও আমাদের এলাকায় লোডশেডিং ছিলো ১১/১২ঘন্টা। আবার মে/২০২৩ মাসের বিদ্যুৎ পেয়েছি সবচেয়ে কম- অথচ সে মাসেই বিল এসেছে অনেক বেশি। এমন যদি হয়, এটি কি তামাশা নয়? সমস্যা কিছু আছে, ছিলো এবং থাকতেই পারে- তাই বলেএমন অসম বন্টন ব্যবস্থা ? তাদের মনে রাখা উচিত এখন মানুষ বিদ্যুৎ ছাড়া বাঁচতে পারেনা- যেমন বলা হয় মানুষ পানি ছাড়া বাঁচেনা। সকল নাগরিকের জন্য একটি গ্ৰহনীয় পর্যায়ে লোডশেডিং করে দেশ ও জাতির মানুষের প্রতি নৈতিক কর্তব্য পালন করা উচিত। আমরা জানি কোন সমস্যা বা কষ্টই স্থায়ী হয় না। যাদের খামখেয়ালিপনার জন্য অসম বিতরন ও কষ্ট সৃষ্টি করা হয় তাও স্থায়ী হবে না। সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা গ্ৰহণ করলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। সরকারের ভাবমূর্তি ও ক্ষুন্ন হবে না। কাউকে কষ্ট দিয়ে নয় মোটামুটি সম বন্টনের মধ্য দিয়ে সকলের সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, সবাই স্বস্তিতে থাকে, দেশ ও দেশের মানুষের উন্নতি হয়। কর্মকর্তা কর্মচারীদের এ বিষয়ে শুভ দৃষ্টির উদয় হোক।
লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।

সংবাদটি সর্বমোট 239 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *