একটি বিজয় জাতির ভাগ্য খুলে দেয়

॥ নূরুদ্দীন দরজী ॥
বিজয় অর্থ পুরোপুরি জায়গা বা পূর্ণ অধিকার। বিজয় শব্দটি শোনা মাত্রই ধমনীতে হিল্লোল উঠে, মন যেন নৃত্য করে। সকল দুশ্চিন্তা ও হতাশা কেটে মনের গভীরে সুবাতাস বইতে থাকে। কিন্তু তার পর ও বিজয় একটি অম্ল মধুর শব্দ। কারণ বিজয় অর্জন করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, দিতে হয় আত্মাহুতি। করতে হয় যুদ্ধ আর সংগ্ৰাম। জগতে মানুষের আবির্ভাব, জীবন সংগ্ৰাম, জাগরণ, শক্তি সঞ্চয় ও সভ্যতার বিনির্মাণে বিজয় মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। যদিও বিজয় অর্জনে জান মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়, রক্ত ঝরে অনেক অনেক। বাঙালি জাতির জীবনে বিজয় এসেছে ১৯৭১ সালে। এ বিজয় আনতে আমাদের এক সাগর রক্ত ঢালতে হয়েছে। শহীদ হয়েছেন ত্রিশ লাখ বীর বাঙালি, সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে তিন লাখ মা বোনের। এর পূর্বে বাঙালি জাতি কোন দিন এতটা একত্রিত হতে পারেনি যতটা হয়েছিলো ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকঠিন নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন করার পর থেকে আমাদের কথা আমরা বলছি, আমাদের দেশ আমরা চালিয়ে আমাদের সবকিছু আমরা করছি। স্বাধীনতা, আত্ম মর্যাদা ও আত্ম অধিকার নিয়ে বেচেঁ আছি। এ মহান বিজয় চিরদিন অম্লান ও অমর করে রাখবো।
বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায় অনেক বিজয় জাতীয়, গোষ্ঠী গত ও ধর্মীয় প্রসারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মাত্র দুই চারটির কথা বলতে প্রথমেই বলবো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কা বিজয়ের সুদূরপ্রসারী ফলাফল কথা। আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রের চরম প্রতিবন্ধকতার মাঝে ও তিনি ইসলামের ঝান্ডা হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। নানাবিধ শত্রুতা এবং যুদ্ধের মাধ্যমে অগ্ৰসর হতে হতে সর্বশেষ হুদাইবিয়ার সন্ধি তাঁর মক্কা বিজয়ের পথ সুগম করে দেয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সকল বাঁধা বিপত্তি ডিঙিয়ে তিনি মক্কা বিজয় করেন। তাঁর এ বিজয়ের ফলাফল অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়। পরবর্তীতে তাঁর অনুসারীগণ ইসলামের পতাকা হাতে শান্তির বাণী নিয়ে সমগ্ৰ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন। প্রায় সারা দুনিয়ায় ইসলাম প্রচার হতে থাকে যার বর্তমান অবস্থা আমরা সবাই জানি। মোঘল সম্রাট আকবর দ্বিতীয় পানি পথের যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেন। তাঁর দাদা জহিরউদ্দিন বাবর মোঘল বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তাঁর ও তাঁর ছেলে হুমায়ুনর সময় তাঁদের অধিকৃত রাজ্য অনেক ছোট ছিলো। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর সিংহাসনে বসলে আদিল শাহ তাঁকে আক্রমন করেন। বেঁধে যায় পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ। আদিল শাহের সেনাপতি বীর হিমু আগ্ৰা ও দিল্লি জয় করে পানিপথের যুদ্ধে অবর্তীণ হন। এ যুদ্ধের দিন আকবর যুদ্ধক্ষেত্র হতে ৮ মাইল দূরে তল্পিতল্পা বেঁধে অপেক্ষা করেছিলেন পরাজিত হলে ভারত ছাড়তে হবে চিরতরে। যুদ্ধে বিজয় প্রায় সুনিশ্চিতের পথে ছিলো – কিন্তু হঠাৎ একটি তীর এসে হিমুর চোখে বিঁধলে তিনি পরাজিত, ধৃত ও হত্যার শিকার হন। আকবর বিজয় অর্জন করেন। পাক ভারত উপমহাদেশে মোঘল শাসন তিনশত বছরের বেশি সময় স্থায়ীত্ব পায়। আকবর হন,” আকবর দি গ্ৰেট,। আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষ জয়লাভ করায় শোষক দেশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ধীরে ধীরে উপনিবেশিক অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
আবার স্বাধীনতা ও স্বীয় অধিকার বজায় রাখতে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধে অনেক জাতির পরাজয় ও হয়েছে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় বাঙালিকে পরতে হয়েছে দুইশত বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির। দীর্ঘ দিনের শোষন বঞ্চনায় পড়ে মানুষদের হতে হয়েছে নিঃস্ব, রিক্ত, কপর্দকশূন। নিজভূমে হয়েছে বিদেশি বেনিয়াদের অবহেলার পাত্র। মহিশুরের টিপু সুলতান অধিকার রক্ষার যুদ্ধে পরাজিত হলে ক্রমান্বয়ে সমগ্ৰ ভারতে চেপে বসে ইংরেজ শাসন শোষণ। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহে বিজয়ে দ্বার প্রান্তে গিয়ে ও পরাজিত হলে ভারতবাসীর উপর অত্যাচারে মাত্রা শত সহস্র গুনে বেড়ে এ দেশের মানুষ অসহ্যনীয় দিন কাটিয়েছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর ও অনেক যুদ্ধে বিজয় না আসায় প্রচুর জান মালের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
কিছু কিছু অন্যায় বিজয়ের হত্যাযজ্ঞে পৃথিবীর কোথাও প্রচুর জীবন ধ্বংস হয়েছে। ব্যাপক ধ্বংস লিলার ভয়াবহতায় পরবর্তীতে বিজয়ীর মনে কৃতকর্মের অনুশোচনা জাগ্ৰত হলে মানসিকভাবে অনেকে ভেঙ্গে পড়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অসংখ্য প্রাণ সংহার ও ধ্বংসের পর পান্ডব পক্ষ জয়ী হলে রাজা হন যুধিষ্ঠির। কিছু দিন রাজত্ব করার পর আত্মগ্লানিতে জ্বলে পুড়ে ক্ষমতা ত্যাগ করে আত্মশুদ্ধির জন্য তিনি চলে যান হিমালয়ের পথ ধরে। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিশাল হত্যা সংঘটিত করায় বিজয়ী সম্রাট অশোক দারুণভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তাঁর মাঝে নিষ্ঠুরতার ছাপ অনুভূত হলে তিনি ধর্মকে আলিঙ্গন করেন। বৌদ্ধধর্মকে আকড়ে ধরে মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। আধুনিক যুগে ও আমরা দেখি পৃথিবীর কোথায় কোন জাতির উপর জুলুম নির্যাতনের পরে অত্যাচারীরা ক্ষমা চেয়ে পরিত্রান পাওয়ার চেষ্টা করে।
আলোচনার মূল বিষয় আমাদের মহান বিজয় দিবস। সুদীর্ঘকাল সুজলা সুফলা, শস্যশ্যমলা ও ঐশ্বর্য্যে ভরা বঙ্গভূমি ছিলো বিদেশি শত্রুদের দখলে। সর্বশেষ ইসলামের দোহাই দিয়ে ২৩ বছর আমাদের শোষণ করেছে স্বৈরাচারী পাকিস্তানীরা। বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে প্রতিবাদ করে কোন সুরাহা না পেয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি নেমে পড়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অর্থাৎ মুক্তির যুদ্ধে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ও ধ্বংস যঞ্চের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের নিকট আত্মসর্মপণ করে। বাংলার আকাশে উড্ডীন হয় বিজয়ের পতাকা। আমরা লাভ করি বহুল আকাঙ্খিত স্বাধীনতা। পাই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ। এ মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর আহবানে আমরা শ্লোগান দিয়েছিলাম,” তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা। অর্জিত বিজয় ধরে রেখে এ পদ্মা মেঘনা যমুনা অবিবাহিকার বঙোপসাগর তীরেই আমাদের থাকতে হবে। ধরে রাখতে হবে মহান বিজয়। অর্জিত বিজয়ের পতাকা বহন করে নিয়ে যেতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে, জন্ম হতে জন্মান্তরে। লেখক: উপদেষ্টা, দৈনিক নরসিংদীর নবকণ্ঠ

সংবাদটি সর্বমোট 133 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *