করিমপুর পাবলিক ইনস্টিটিউট ও মোশাররফ হোসেনের সম্পৃক্ততা

গাজী হানিফ মাহমুদ:
করিমপুর। চার দিকে মেঘনা নদীবেষ্টিত নরসিংদী সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এক সময় বর্ষায় নৌকা আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হাটা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। আর এ প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের জন্মনিয়েই দেওয়ান এ কে বাহারুল উলুম, সফিকুল আলী আজগর, সামসুল হুদা, বদরুজ্জামান পাঠান, আজিজুর রহমান পাঠান, মনোহর আলী, সাইদুজ্জামান শুকুর আলী, মোজাফফর হোসেন ভুইয়া, সাইদুর রহমান,খোরশেদ আলম,ওমর আলী ও তোরাব আলীসহ তৎকালীন সময় কয়েক জন উদ্দমি তরুণ যুবক এলাকার আর্তসামাজিক উন্নয়নে ১৯৪৮ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন করিমপুর পাবলিক ইনষ্টিটিউট নামে একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
তখনকার সময় এ ইনষ্টিটিউট ছিল ঘোটা চরাঞ্চলের সমাজ জীবনের বিবিধ অঙ্গনে উন্নয়ন কর্মকান্ডে তথা সেবা ধর্মীয় শিক্ষা সাংস্কৃতির ও আর্দশের মূলভিত্তি।
তাই সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ আর চরাঞ্চলের গ্রামীণ কুসংস্কারের বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত করে সম্ভব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও প্রগতিশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্যই এ করিমপুরের তরুণ স্বপদ্রষ্টারা এই পাবলিক ইনষ্টিটিউটের গোড়া পত্তন করে ছিলেন।
তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল নবজাগরনের সারা। আশা উদ্দিপনায় ভরে উঠেছিল চরাঞ্চলের মন প্রাণ। কিন্তু লক্ষ্যে পৌচ্ছার আগেই সেই যাত্রাপথ হারিয়ে যায়। নির্বাক আর নিথর হয়ে পড়ে সেই ইনষ্টিটিউট।
অবশেষে আশি দশকের শেষ দিকে এর হাল ধরেন এ করিমপুর এলাকারই আর এক সন্তান মোশাররফ হোসেন সরকার। তিনি অনেক দিন ধরে নিষ্কৃয়ভাবে পরে থাকা এ পাবলিক ইনষ্টিটিউট কার্যক্রম স্থানীয় শিক্ষিত যুব সমাজকে নিয়ে পূনরায় তার কার্যক্রম শুরু করেন। দায়িত্ব নেন এ ইনষ্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদকের। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তৎকালীন সময় সমগ্র চরাঞ্চলের তথা ৪টি ইউনিয়নের সাহিত্যমনা,সৃজনশীল ব্যক্তিদের নিয়ে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধকরতে রাষ্ট্রিয় ও জাতীয় ভাবে পালনকৃত এ দিবস গুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আয়োজন করতেন।
আর সে খানে খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এ সকল সামাজিক কর্মকান্ডে সময় দিতে গিয়ে নিজরে স্বচ্ছলতার কথা ভাকবেনি, ভেবেছেন তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা নিয়ে। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চরাঞ্চলের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সমন্বয়ের তাদের স্ব-স্ব এলাকার বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য এবং জন্মভূমির প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
মোশাররফ হোসেন সরকার আশিদশক থেকে ‘পাবলিক ইনষ্টিটিউট’ এর মুখপাত্র ‘মেঘনা’ নামে একটি স্মরণিকা নিয়মিত প্রকাশ করে চরাঞ্চলের ইতিহাসকে সুদৃঢ় করেছেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি চরাঞ্চলেরসহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক লেখার মাধ্যমে জনসুখে তুলে ধরতেন।
তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্রর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে কর্মজীবনের প্রবেশ করেন। চাকুরী নেন সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধিনে সরকারী জাতীয় গন্থকেন্দ্রে। তিনি চাকুরী পাশাপাশি বাসায় প্রচুর পড়াশুনা করতেন। এমনকি একবার বেতনের পুরো টাকা দিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে নিলামে স্বাধীনতার যুদ্ধের দলিল ১৬ খন্ড বই কিনে বাসায় নিয়ে আসেন। তিনি চিন্তুা করনেনি কিভাকে তার সংসার চলবে। এ নিয়ে সাংসারিক জীবনে টানা পরাই ছিল। তার পরও ক্ষান্ত থাকেননি। উনার সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। অত্যন্ত কঠিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি সমগ্রহ নরসিংদী জেলার বীরাঙ্গনাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জীবন কাহিনী তুলে ধরেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস নিয়ে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। বীরাঙ্গনাদেরে অধিকার রক্ষায়ও লড়াই করেছেন জীবনের পদে পদে। তিনি মনে করতেন একটি সমৃদ্ধ এবং অর্থবহ রাষ্ট্রের জন্য সেই রাষ্ট্রের জন্মদানের ভূমিকা যাদের ত্যাগ তাদের সম্মানই নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এ বিষয়কেই তিনি হৃদয় ধারন করছেন। তিনি নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লিখেছেন হাজারো পৃষ্ঠা। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস নামক একটি বইও প্রকাশ করছেন।
নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরীর (১৯৯৪) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে সম্পাদক হিসেবে উক্ত লাইব্রেরীর মুখপত্র, রক্তাক্ত’৭১ নামে নিয়মিত প্রকাশনা প্রকাশ করেছেন,এছাড়াও তিনি নিজ কর্মক্ষেত্র দেশের শীর্ষ স্থানীয় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন প্রতিষ্ঠান সমূহের কর্মচারী ফোরামের সাময়িকী ‘জ্যোতি’ এ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক,সাপ্তাহিক, গ্রন্থকেন্দ্রের মাসিক বই নরসিংদীর স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় ও স্মরণিকায় বিচ্ছিন্ন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখা প্রকাশ হয়েছে। বিশেষ করে উল্লেখ যোগ্য,এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা মিডিয়া ১/১-১০খন্ড।
সে মানুষটির আজ আমাদের মাঝে নেই। আজ ১২ এপ্রিল (রবিবার) মোশাররফ হোসেন সরকার এর ৩য় মৃত্যুবাষির্কী। ২০২০ সালে ১২ মার্চ এ দিনে তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯৫৬ খ্রি: নরসিংদী সদর উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নে করিমপুর গ্রামে একটি মুসলিম পরিবার জন্ম গ্রহণ করেছিলন। তার পিতা:বাহাউদ্দিন সরকার ও মাতা মোসা: মেহেরুন্নেসার ৮ সন্তারের মধ্যে মোশাররফ হোসেন সরকার ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে পেশায় ছিলেন একজন সরকারী চাকুরীজীবি।

সংবাদটি সর্বমোট 281 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *