দানবের বিনাশ অবশ্যই; দেবী দুর্গাই প্রমাণ

॥ নূরুদ্দীন দরজী ॥
আমাদের দুর্গতি যায় না! যাবে কেমনে, আমি তো আমাকে চিনি না! নিজেকে যে জানে সে অতীতচারী হয়েও বর্তমানকে ভালোবেসে সামনের দিকে এগোয়। এগোনোর পথ মসৃণ নয়; অসংখ্য কাঁটা। যে কাঁটা মাড়িয়ে রক্তাক্ত হতে হতে সত্যে পৌঁছায় প্রকৃতি ও সর্বজীব। সে তো হাঁটার মধ্যে নিজেকে চিনে নেয়। এ কর্ম সহজ নয়! যে পারে সেই পারে। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সামনে এগোনোর সঠিক পথ এত সহজ নয়। যেমন সহজ নয় মানুষ হওয়া। ‘মান’ আর ‘হুশ’ যুক্ত হয়ে মানুষ হয়। সেই মানুষ হওয়ার দীক্ষা যে নেয় অথবা একসঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা যে নেয় পরম গুরুর কাছ থেকে সে মানুষ হয়। মানুষ হতে হতে সে মনুষ্যত্বে পৌঁছায়। এ কাজ খুবই কঠিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মনুষ্যত্ব সবার ঘরে জন্মে না’। কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে ঈশ্বরের সীমাহীন করুণায় মনুষ্যত্ব জন্মে। যাই হোক, সনাতন ধর্ম মতে বলছিলাম দুর্গতির কথা। দুর্গতিনাশিনীর কথা।
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই কল্যাণকামী মানুষের পাশাপাশি যুগে যুগে আর্বিভূত হয়েছে দুষ্টু চক্র। মানবের ক্ষতি সাধনে দানবের পেতাত্মারা দিয়েছে বিশাল থেকে বিশালতর হাসি। বার বার সৃষ্টিকে ধ্বংস করার জন্য দানবকুল চেষ্টা করে গেছে। এদের দমনে সাধারণ মানুষকে রক্ত ঝরাতে হয়েছে। দুষ্টু চক্রের নিপাতের জন্য সংগ্ৰাম করতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে ও পৃথিবীর কোথায় না কোথাও মানবতা বিরোধী দুষ্ট চক্রের আর্বিভাব ঘটে থাকে যার জন্য সে এলাকার মানুষকে রক্ত ঝরাতে হয়, জীবন দিতে হয়। কিন্তু এ কথা সত্যি যে, সৃষ্টির পর কোন কালেই কোন জায়গায় দানবেরা টিকে থাকতে পারেনি, তাদের ধ্বংস অনিবার্যভাবে হয়ে যায়। অর্থাৎ দানবের মৃত্যু অনিবার্য। তবে তাদের পেতাত্মা আবার মাথাচাড়া দিতে চেষ্টা করে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শুরু হয়ে গেছে মহা ধুমধামে দূর্গোৎসব। মহালয়ার মাধ্যমে উৎসবের শুভ সূচনা হয়েছে। দানব তথা অসুর শক্তিকে বিনাশ করে দূর্গা দেবীর মর্তে আগমনে ধন্য ধন্য পৃথিবী, ধন্য ধন্য মানবকুল। দূর্গা হযয়েছেন দূর্গতী নাশিনী। তিনি হয়েছেন মহা শক্তির আধার। দানব শক্তি তাঁর কাছে ধরাশায়ী। অধর্মের হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করেছেন তিনি। স্বর্গ, মর্ত আর পাতালে নেমে এসেছে শান্তির বাতায়ণ। নমিত হচ্ছন দেবী মহা স্বয়ম্ভরে। ধর্মের গ্লানির অবসান হয়ে ধরণী হয়েছে শান্তিময় ও পুলকিত।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে অনেক অনেক দানব চরিত্র রয়েছে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ উল্লেখিত দানবের মধ্যে আছে কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল, রাবণ, হিরণ্যকশিপু ও অসুর বা মহিষাশুর। তবে সব চেয়ে লক্ষনীয় ও শিক্ষনীয় হচ্ছে-এ সমস্ত চরিত্রগলোর মধ্যে প্রায়ই পারস্পারিক যোগসূত্র রয়েছে।
দুর্গতি যে নাশ করে সে-ই তো দেবী দুর্গা। পৌরাণিক কাহিনির পরতে পরতে আছে, জল আর কাদামাখা সাধারণ মানুষের ব্যথাভরা বিস্ময়ভরা গল্প! মানুষ সব সময়ই শক্তির পূজারি। সেই আদিকাল থেকেই মানুষ ভয় পেয়েছে যেখানে, সেখানেই মাথা অবনত করেছে। সেই অবনত মস্তকে প্রকৃতির নানা জীব-বৈচিত্রের মধ্যে অজানাকে প্রণাম জানায় আদিম মানুষ। সেই প্রণাম সৃষ্টিকর্তার হূদয়ে শঙ্খধ্বনি হয়ে বাজে। সেই ঈশ্বরের ধ্বনি সুর আর অসুরের দ্বন্দ্বে প্রতিফলিত হয়। প্রতিবিম্বিত হয় মানুষের গুহাচিত্রের বর্ণনায়। জগতজোড়া দ্বন্দ্ব্ব। কু আর সু’র। এই দ্বন্দ্ব্বে মানুষ সারিবদ্ধ মূর্তিমালাকে পূজা করে।
অসুরদের অত্যাচারে দেবতারা যখন কেঁপে উঠে ভয়ে, তখন সব দেবতার তেজরশ্মি থেকে দুর্গা আবির্ভূতা হন। দশভুজা হয়ে দেবী দুর্গা অসুরদের বিনাশ ঘটালেন। এই বিনাশকালে রাম-রাবণের যুদ্ধে স্বয়ং ব্রহ্মা রামের পক্ষ নিলেন। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে ব্রহ্মার বোধনে রাম দুর্গা পূজা দিলেন। একে সনাতন ধর্মে দুর্গার অকাল বোধন বলে। চৈত্রের শুক্লপক্ষে পূজা পায় বাসন্তী হয়ে। স্ব-কালে দাঁড়িয়ে দশভুজা হয়ে দেশকে সাজায়। দু’হাত হয়েও তিনি দশরূপা হোন। সে তো দুর্গাসম। সেই দুর্গার ছায়াসম হয়ে আমরা বারবার বেঁচে উঠি। প্রখর রৌদ্রে হঠাত্ আকাশ অন্ধকার। সে অন্ধকার ঘরকে আলো জ্বেলে দেয়। দুই হাত তখন দশ হাত হতে হতে হাজার হাত ছায়াসম হয়ে—নাচি বাদ্যের তালে তালে; দুর্গার আগমণী বার্তায়।
মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষ অবসান হয়। মাতৃপক্ষের সূচনালগ্নে সত্য হয়ে ‘পদ্ম’ ফোটে। ঠিক এ সময়ে আক্ষরিক অর্থে দুর্গা পূজা চর্চিত হয়ে আসছে আমাদের মনের গহীন অতলে। জ্ঞানমত্ কথ্যমতে, মহালয়ার দিন অসুর ও দেবতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। দেবী দুর্গা মা-সম হয়ে মহিষাসুর বধ করেছিলেন। এ লড়াই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
এবার সবচেয়ে বড় দূর্গা পূজা হচ্ছে অসুররূপী করোনার সময়ে। এ করোনা বিশ্বব্যাপী মহা আতংক সৃষ্টি করেছে। কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের জীবন। দুর্বিষহ ও অশান্তিময় করে তুলেছে স্বাভাবিক জীবন। এর মধ্যে বেজে উঠেছে দেবীর আগমনী সুর। বোধনের মাধ্যমে চলছে পূজা অর্চনা। সমগ্র বাংলাদেশে শুরু হয়েছে সেই চিরাচরিত আনন্দ ধারা। আদিকালে ছুটাফাটা হলে ও এখন দূর্গা পূজা সার্বজনীনতা লাভ করেছে। এর আনন্দ এখন বাঙালির ঘরে ঘরে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দূর্গা পূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, এটি এখন সার্বজনীন উৎসব। এ সার্বজনীনতায় দূর হয়ে যাক সকল কালিমা, সকল অন্যায় অবিচার ও অশান্তি। সকল হিংসা হানাহানি দূর হয়ে সবার মাঝে বিরাজ করুক ভ্রাতৃত্ব বোধ। অশুভ শক্তির চির অবসান হোক। মানুষ থাকুক শান্তিতে।  উপরোক্ত লেখাটি সনাতন ধর্মীয় তথ্যমতে লেখা হয়েছে। লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও) ও উপদেষ্টা, দৈনিক নরসিংদীর নবকণ্ঠ

সংবাদটি সর্বমোট 315 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *