দুর্নীতি ও বিবেকের তাড়না

নূরুদ্দীন দরজী:
বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ে বিপুল আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি শব্দটির সাথে এবং দুর্নীতি করা বিষয়ে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। সহজ করে বলতে গেলে-প্রতিটি কাজ করতেই কিছু না কিছু ক্ষমতা বা শক্তি লাগে। আর সেই শক্তি প্রয়োগ যদি যথাযত না হয় তাই দুর্নীতির পর্যায়ে চলে আসে। এখন যে দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা আমাদের জন্য ও দেশের জন্য করাল গ্লাসে পরিনত হয়েছে। দুর্নীতিতে দেশের মানুষ নাভিশ্বাস অবস্থায় পড়ে গেছে। জনগণ অধিক মাত্রায় তিক্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছেন।
– দুর্নীতি কাকে বলে – এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, একটি সমাজ বা রাষ্ট্র তার নিজস্ব কাজ কর্ম পরিচালনা বা সম্পন্নের জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে কিছু ক্ষমতা প্রদান করে থাকে। যারা প্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে তাকেই দুর্নীতি বলে। ওই ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হয়ে থাকেন জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী। জনগণের ম্যান্ডেট অথবা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে জনগণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেে এবং নিজের স্বার্থ হাসিল যারা করে তারাই দুর্নীতিবাজ। অনেক সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী প্রাপ্ত ক্ষমতার দারুনভাবে অপব্যবহার করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলে। নিজেরা বাড়ি গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স করতে থাকে এবং বিদেশে অর্থ পাচার করে ভবিষ্যৎ সুখের সন্ধান করে। থলের বিড়াল যদি কখনো বের হয়ে আসে তখন তাদের নীতি নৈতিকতাহীন কাজগলো দেখে মানুষের মন ঘৃনার ভরে যায়। যে সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতো সহসা তাদের অঢেল সম্পদের পাহাড় দেখে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। বর্তমান সময়ে আমরা এমন কয়েকজনের নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকান্ডে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছি, এমন দুর্নীতিবাজদের দেশের প্রায় সকল বিবেকবান মানুষ‌ চিনে ফেলেছে। দুর্নীতির এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমাদের দেশকে, দেশের মানুষকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে চিন্তায় আছেন। আজ সমগ্ৰ বাংলাদেশের মানুষের প্রধান ও অন্যতম দাবী- ‌দুর্নীতি অবশ্যই দমন করে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। এ অবস্থা চলতে পারেনা মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। দুর্নীতি গণতন্ত্রের ভিতকে দুর্বল করে দেয়। আমরা যেভাবে উন্নয়ন করে চলেছি যে কোন প্রকার দুর্নীতি সে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে চরম বাঁধা।
যে কথাটি আমরা প্রায়ই শুনি তা হলো, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই কমবেশি দুর্নীতি হয়ে আসছে। দুর্নীতি কখনো শেষ হয় না বা সমূলে মূলোৎপাটন করা যায়নি। দুর্নীতি উইপোকার মত। তানজানিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নাইরেরে বলেছেন,” দুর্নীতি উইপোকার মত সমাজের ভিত খেয়ে ফেলতে পারে, একেবারে শেষ করতে না পারলেও দমন করে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন করা সম্ভব।, আর যদি তা সম্ভব না হতো পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষ এতটা উন্নত করতে পারতো না।
বড় কথা হচ্ছে -দুর্নীতির দমনের সাথে নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। আমরা জানি, মানুষের মনে নৈতিক এবং অনৈতিক নামের দুইটি শক্তি কাজ করে। শুধু কাজই করে না তারা নিজেরা জবরদস্ত লড়াই ও করে। যতক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক শক্তি প্রবল থাকে ততক্ষণ সবকিছুই সঠিক পথে চলে। কিন্তু নৈতিক শক্তি পরাজিত হলে অনৈতিক শক্তি মারাত্মকভাবে থাবা বিস্তার করে। এর ফলে আরম্ভ হয়ে যায় সকল অপকর্ম ও দুর্নীতি। সমাজে বেড়ে চলে বঞ্চনা ও অসাম্য। তবে নৈতিক শক্তিকে সাহস দিতে,সরল পথে আনতে কাজ করে যায় সৎ মানুষেরা। কাজ করে ধর্ম, বিবেক, নীতিশাস্ত্র ও আইনআদালত। বলা হয়ে থাকে,” মানুষের বিবেক পৃথিবীর সর্বোচ্চ আদালত।, আর মানুষের বিবেক যদি জাগ্ৰত ও সক্রিয় থাকে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজরা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে বাধ্য হয়। দেশের প্রচলিত ব্যবস্থা তথা রাজনীতির সাথে দুর্নীতির সম্পৃক্ততার কথা বলেন অনেকে। কথাটি অমূলক নয়। একটি দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্গ যদি সঠিক পথে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হন সেখান থেকে দুর্নীতি দমনে আনা সহজ হয়ে উঠে । আমাদের বর্তমান সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতা দেখিয়ে থাকেন। মহান সংসদে তিনি দুর্নীতিবাজদের জন্য কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা দুর্নীতিবাজদের ধরবো।,আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগের আহবান জানিয়েছেন।

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে অনেক অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। মোটেও পছন্দ করতেন না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তিনি অনেক অনেক কঠোর কথা বলেছেন। দুর্নীতিবাজদের অবসান ও অবশ্যই নির্মূল তিনি চেয়েছিলেন। বলেছেন,” নেশনস মাষ্ট বি ইউনাইটেড এগেইনস্ট করাপশন। তিনি আর ও চেয়েছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার সহ সমাজে বসবাসকারী সকলকে আন্তরিক হতে হবে। মানুষের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ জাগ্ৰত হতে হবে।
মনে রাখতে হবে এ দেশ, বাংলাদেশ আমাদের সকলের। বাংলাদেশ আমাদের অহংকার, আমাদের ভালোবাসা। আমরা প্রতিদিন লাখ কন্ঠে,কোটি কন্ঠে উচ্চারণ করি, গেয়ে উঠি,” আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।, স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের শ্লোগান ছিলো এবং আমরা গেয়েছি, ” তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।, যারা দুর্নীতি করে তাদের কাছে একটি প্রশ্ন, এ দেশে আপনার বাবা দাদারা কি পদ্মা, মেঘনা যমুনা পাড়ে বসবাস করতেন না ?, তাঁরা কি দেশকে প্রাণের চেয়ে ও ভালোবেসে দেশের জন্য যুদ্ধ করেনি? রক্ত দেয়নি ? পূর্ব পুরুষদের অস্বীকার করে,যে বাংলার মাটিতে তারা শুয়ে ও মিশে আছেন তা ফেলে রেখে বিদেশে সুখের অনুসন্ধান আপনি কিভাবে করছেন? মনে রাখতে হবে, এ পৃথিবীতে আমরা যেমন কেউ চিরদিন বেঁচে থাকবো না, তেমনি আপনি ও বেঁচে থাকতে পারবেন না। আপনি যদি বেঁচেই না থাকতে পারেন এবং ভোগই না করতে পারেন তাহলে কার জন্য দুর্নীতি করছেন, কার জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন ?,ক্ষমতা ও শক্তি চিরদিন থাকে না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। দুর্নীতি করে জাতির নৈতিক অধপতন ডেকে আনা অন্যায়। প্রত্যাশায় রই দুর্নীতি যারা করে তাদের বিবেকের তাড়না অনৈতিক শক্তিকে পরাজিত ও মারাত্মক আঘাত করে নৈতিক শক্তি জাগিয়ে তুলবে। বিবেক তাড়না দিবে, তারা তাড়িত হবেন। আমাদের প্রিয় মাতৃভুমিতে দুর্নীতি দমন করে দেশকে এগিয়ে নিবে ।

লেখকঃ সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সংবাদটি সর্বমোট 759 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *