পুরান ঢাকায় ফের আগুন ট্র্যাজেডি, পুড়ে অঙ্গার ৫ শ্রমিক

রেজোয়ান বিশ্বাস ও মোবারক আজাদ:

পুরান ঢাকায় ফের আগুন ট্র্যাজেডি। এবার নিহতের তালিকায় যুক্ত হলেন পাঁচজন। এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১২৪ জন, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৭১ জন।

সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি জুতার কারখানায় বৃহস্পতিবার রাত ১টায় আগুন লাগে। ওই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন পাঁচজন শ্রমিক। প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস জানতে পেরেছে, কারখানাটির ভেতরে রাখা রাসায়নিক (কেমিক্যাল) থেকে আগুনের সূত্রপাত।

নিহতরা হলেন বরিশালের আব্দুর রহমান রুবেল (৩৫), চাঁদপুরের মনির হোসেন (৩১), কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মো. শামিম মিয়া (৩৫), শেরপুরের কামরুল ইসলাম (২২) এবং মানিকগঞ্জের আমিনুল (৩০)। তাঁরা সবাই ওই কারখানার শ্রমিক ছিলেন। এ দুর্ঘটনায় আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন। নিহত ও আহতদের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের জুতার কারখানার নিচতলায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা অন্য কোথাও থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে রাসায়নিক দ্রব্য থাকায় মুহূর্তে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারখানার দ্বিতীয় তলায় ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট সেখানে পৌঁছে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

মরদেহগুলো উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় নিহতদের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট।

সরেজমিন : গতকাল সকাল ৯টায় দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় ওই কারখানার শ্রমিক শান্তর সঙ্গে। কালের কণ্ঠকে তিনি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচছি। রাত তখন ১টার বেশি। কারখানার নিচে কাজ চলছিল। ওপরে দোতলায় ঘুমিয়ে ছিল পাঁচজন। আমিও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তার আগে মোবাইলে কথা বলতে কারখানার সামনে যাই। এ সময় কারখানার মাল রাখার গুদামে আগুন লাগে। নিচতলায় তখন ৩০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করছিল। দ্রুত তারা কারখানা থেকে বের হয়ে আসে। ওপরে যারা ঘুমিয়ে ছিল, তারা বের হতে পারেনি। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরে তখন অনেক চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।’

কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে রাখা আছে রাবারের প্রচুর কাঁচামাল, ড্রাম ভর্তি কেমিক্যাল, জুতা তৈরিতে ব্যবহার করা ডিওপি তেল। প্লাস্টিকের বেশ কিছু বড় ড্রামও চোখে পড়ে। ওই ড্রামে রাসায়নিক রাখা হতো জানিয়ে এক শ্রমিক বলেন, ‘কারখানাটিতে মূলত জুতার সোল তৈরি করা হয়। কারখানায় ২৪ ঘণ্টা চলে কাজ।’

দোতলায় শ্রমিকরা যেখানে ঘুমাতেন, সেখানে প্রবেশের দরজাটি সরু। একটি রুমে বিশেষ কায়দায় স্টিলের পাটাতনের ওপর শ্রমিকদের ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল।

পুড়ে ছাই কাঁচাবাজার : জুতার কারখানার আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে পাশের মদিনা কাঁচাবাজারে। সেখানে নিত্যপণ্যের ১০টি দোকান পুড়ে গেছে।

গতকাল দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত বাজারটির মাংসের দোকানি রফিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার প্রস্তুতির সময় জুতার কারখানার ভেতরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ থেকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুন কাঁচাবাজারে ছড়িয়ে পড়লে ফ্রিজে রাখা আমার ৭০ হাজার টাকার মাংসসহ ফ্রিজটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

লাপাত্তা মালিক : অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানার মালিক রফিক হাজিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় লোকজন জানায়, ১০-১২ বছর আগে রফিক হাজি এই জমি লিজ নিয়ে কারখানা গড়ে তোলেন। কারখানাটিতে বার্মিজ ও প্লাস্টিকের স্যান্ডেল ও সোল তৈরি করা হতো। কারখানাটিতে কাজ করতেন ৪৫ জন শ্রমিক।

এদিকে গতকাল সকালে দুর্ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা।

সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের প্রধান পরিদর্শক সাইফুর রহমান ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। কেমিক্যালসদৃশ কিছু আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে। ল্যাবে পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে, এগুলো দাহ্য কোনো কেমিক্যাল ছিল কি না।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে প্রচুর পরিমাণে রাবারের কাঁচামাল পাওয়া গেছে। রাবার এক ধরনের পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ। এ ছাড়া সেখানে ডিওপি তেল মজুদ ছিল। এটিও দাহ্য পদার্থ। তদন্তের পর অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ জানা যাবে। এ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইউম বলেন, পাঁচ শ্রমিকের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

মর্গে লাশের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা : সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে বাবার লাশের জন্য অপেক্ষা করছিল শিশু নাহিদ হাসান। শিশুটির দাবি, সোয়ারীঘাটের কামালবাগে জুতার কারখানায় আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া পাঁচজনের মধ্যে তাঁর বাবা মনির হোসেনের লাশটিও আছে।

নাহিদের সঙ্গে থাকা তার ফুফা আলী হোসেন বলেন, চাঁদপুরের মতলবের আবুল হোসেনের ছেলে মনিরের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে নাহিদ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। অন্য দুই সন্তান নিয়ে স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মনিরের টাকায় সন্তানদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসার চলত। এখন পরিবারটি কিভাবে চলবে, তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।

এ সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গের সামনে মনিরের স্বজনরা ছাড়াও আরো উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জের আমিনুর, বরিশালের আবদুর রহমান, কিশোরগঞ্জের শামীম মিয়া, শেরপুরের কামরুল ইসলামের স্বজনরা।

আশুলিয়ায় জুতার কারখানায় আগুন

সাভার প্রতিনিধি জানান, আশুলিয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে একটি জুতা তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে সাভার ও আশুলিয়া ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আড়াই ঘণ্টা চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে নরসিংহপুরের সরকার মার্কেট এলাকার পেস ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেড নামের জুতা তৈরির কারখানায় এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

ডিইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার জাহাঙ্গির আলম বলেন, কারখানার ভেতরে কেমিক্যাল থাকার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কারখানার পাশে কেমিক্যালের ময়লার স্তূপ থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত।

রূপগঞ্জে টেক্সটাইল কারখানায় আগুন

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রূপগঞ্জে একটি টেক্সটাইল কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে ওই কারখানায় থাকা কাপড়, সুতাসহ মেশিন পুড়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে উপজেলার কাঞ্চনবাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

কাঞ্চন ও পূর্বাচল ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, দ্রুত আগুন নেভাতে না পারলে আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে আরো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতো। সূত্র: কালের কণ্ঠ

সংবাদটি সর্বমোট 233 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *