নূরুদ্দীন দরজী:
২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস। ৫৩ বছর আগে এ দিনে আসাদের টগবগে লাল রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। রাজপথ ফুঁসে উঠেছিল। তাঁর রক্তের স্রোতধারা বিস্মৃত হয়েছিল বাংলার পথপ্রান্তে, গ্রামেগঞ্জে,হাটবাজারে,প্রতিটি বাঙালির ঘরে উঠানে। বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে সমগ্ৰ বাংলায় সৃষ্টি করেছিল বজ্র ও বজ্রপাতের। বাঙালির রক্ত, ধমনি, শিরা উপশিরায় সৃষ্টি করেছিল আগুনের ফুলকি। সমগ্ৰ দেশের মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে মুক্তির মিছিলে। এ মিছিল ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যার ফলশ্রুতিতে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আমাদের বাংলাদেশে ছিল তাদের পাকিস্তান। পাকিস্তানেীদের শাসনের নামে শোষন নির্যাতনে বাংলা ছিল ওষ্ঠাগত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃতে বাঙালি জাতি জীবন মরণ সংগ্ৰাম করে যাচ্ছিল। সংগ্ৰামের বিভিন্ন ধারাবাহিকতার পথে এ দেশের মানুষ পালন করে আসছিল নানা কর্মসূচি। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ১১ দফা দাবীতে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হয়েছিল। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন জননেতা তোফায়েল আহমদ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্ৰাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তোফায়েল আহমদ ঘোষণা করেছিলেন,”যতদিন পর্যন্ত আগরতলা মামলার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে প্রিয়নেতা শেখ মুজিব ও অন্যান্য সকল রাজবন্দিদের মুক্ত না করতে পারবো ততদিন আমাদের এ আন্দোলন চলবে। আইয়ুব মোনায়েম শাহীর পতন না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র সমাজ ঘরে ফিরবেনা বলে দৃপ্ত শপথ নেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল নেমে আসে ঢাকার রাজপথে। আইয়ুর শাহীর জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষনা দেওয়া হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে অদৃশ্য হয়ে যায় ১৪৪ ধারা।
মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তৎকালীন তুখোর ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ, মোহাম্মদ আলী এবং আসাদুজ্জামান আসাদ। আইয়ূব খানের নির্দেশে তাঁদের লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ে এক পাষান্ড পুলিশ ইনস্পেক্টর। সে গুলি লাগে আমাদের আসাদের বুকে। সাথে সাথে অকুতোভয় আসাদ ঢলে পড়ে যান। সাথীরা ধরাধরি করে তাঁকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে পৌছার আগেই তাঁদের হাতে আসাদ মারা যান,তিনি শহীদ হন। মেডিকেলের সিঁড়িতে তাঁর প্রাণহীন লাশটি রাখা হয়। গায়ের গুলিবিদ্ধ রক্তে মাখা শার্টটি তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্ৰামের পতাকা হয়ে যায়। শার্টকে পতাকা করে সম্মিলিত ভাবে সকলে শপথ গ্ৰহণ করেন-দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ মায়ের কোলে ফিরে যাবেন না।
অতঃপর লাশ নিয়ে আসা হয় শহীদ মিনারে। আসাদের শহীদ হওয়ার খবর সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্ৰ বাংলার আনাচে-কানাচের মানুষ শোকার্ত হয়ে পড়ে। রক্তমাখা লাশ সামনে রেখে কঠিন শপথ নেয় তারা ,”আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দিবনা,। ২১ জানুয়ারি পল্টনে তাঁর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর লাশ নিয়ে আসা হয় নরসিংদীর শিবপুরে নিজ জন্মভূমির মাটিতে। ধানুয়ায় শিবপুর হাইস্কুল মাঠে জানাজা পড়ে বাড়ির সন্নিকটে মসজিদের পাশে কবরে রাখা হয় যা এখন আসাদ সমাধি। অন্য দিকে সারা বাংলার মানুষ তাঁর দেওয়া রক্তে বাঙালি সত্তার অস্থিতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকাসহ সারা দেশ লক্ষ লক্ষ মানুষের শোক মিছিলে ছেয়ে যায়। এ দেশ থেকে পাকিস্তানীদের বিতারিত না করা পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্ৰাম চলবেই ঘোষনা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি মিছিল বিশালতর হলে পুলিশের গুলিতে মতিউরসহ আর ও কয়েকজন তরুন প্রাণ শহীদ হন।
আসাদ শহীদ হওয়ার দিন অর্থাৎ ২০ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া অগ্নিঝরা সংগ্ৰামের লেলিহান শিখা জ্বলে জ্বলে বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে অগ্ৰসর হতে থাকে। এমনতর অবস্থায় পরবর্তী ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে আলটিমেটাম দেওয়া হয়,”২৪ ঘন্টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে,। আসাদ শহীদ হওয়ার প্রায় ৩২ দিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি সঘোষিত তথাকথিত লৌহমানব নামধারী আইয়ুব খান বাঙালিদের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আসাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে সংগ্ৰাণ এগিয়ে যায় দুর্বার গতিতে।
পরের ইতিহাস সবারই জানা। এ সংগ্ৰামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপই আমাদের নিয়ে যায় স্বাধীনতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। আজ আমাদের নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে আসাদকে । জানতে হবে শহীদ আসাদের অবদানের কথা। আসাদকে স্টাডি করতে হবে। তা না হলে আমরা অকৃজ্ঞ হয়ে পড়বো।
শহীদ আসাদ জীবনভর বাংলার স্বাধীকার ও মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। আমরা আজ যে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বসবাস করছি তা অর্জনের সূচনালগ্নে এর মাটি ভিজেছিল আসাদের লাল রক্তে । সে রক্তের গন্ধ এখনো পাই ঘ্রাণ নিয়ে। আজ ও আসাদের রক্তস্নাত হয়ে আছে এ দেশের মাটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দলন ও সংগ্ৰামের পথ পরিক্রমার স্মৃতিতে শহীদ আসাদ, জাগরিত করে প্রতিটি বাঙালিকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এসেছিল উন সত্তরের গণ অভূল্থান ,এ অভূল্থানের মহা নায়ক শহীদ আসাদ। আসাদ আমাদের দীপ্ত অঙ্গিকার। আসাদ একটি অলিখিত মহাকাব্যের নায়ক। এ নায়কের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে চিরকাল বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায়। লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)
সংবাদটি সর্বমোট 224 বার পড়া হয়েছে