এ কে এম শাহনাওয়াজ:
একটি জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক থাকে। নানা ঘটনা স্মৃতিময় করে রাখে এই বাঁকগুলোকে। নতুন প্রজন্মের জন্য ছড়িয়ে দেয় প্রেরণা। ইতিহাসের পাতায় অনন্য সংযোজনে চিরভাস্বর হয়ে থাকে।
সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলার ইতিহাস সোনালি ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। এই ঐতিহ্যের প্রেরণা একটি জাতিকে নতুনভাবে জাগিয়ে দিতে পারে। এগিয়ে নিতে পারে সুন্দর সম্ভাবনার দিকে। তবে এর জন্য চাই যোগ্য কাণ্ডারি অর্থাৎ নেতৃত্ব। এ জায়গাটিতেই বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে আমাদের। প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে নষ্ট রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, এর ঐতিহাসিকতা প্রজন্মের জন্য সঠিক আলোকবর্তিকা হতে পারে। কিন্তু একে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। মানতে হবে ইতিহাসের সত্য ফিরে আসেই। মূর্খই শুধু ইতিহাসকে অস্বীকার করে।
৭ই মার্চের ভাষণ ছিল সমকালীন রাজনীতির এক অনিবার্য পরিণতি। বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা জানেন এ মাটি পরাভব মানেনি কোনোকালে। খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দে বাংলার মানুষ—অস্ট্রিক, নিষাদ, সাঁওতালরা আর্য আগ্রাসনকে থামিয়ে দিয়েছিল। আর্যগ্রন্থ এ মর্মজ্বালা ভুলতে পারেনি। ভারত গ্রাস করে আর্য আগ্রাসন বাংলার প্রতিরোধে থমকে যাবে—এমনটি ভাবা খুব কঠিন ছিল। তাই মুখ রক্ষার জন্য গল্প ফেঁদেছে আর্যগ্রন্থগুলো। বলেছে, অস্পৃশ্য বর্বর দেশ বাংলা। এখানে মানুষ পাখির মতো কিচিরমিচির করে কথা বলে। নীল রক্তের ধারক আর্যরা তাই ইচ্ছা করেই প্রবেশ করেনি এ দেশের সীমানায়। এ ধরনের ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রভুত্ব করার বাসনা সুপ্ত থাকে। একইভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিজ অঞ্চলের তরুণসমাজকে শেখাত বাঙালিকে ঘৃণা করতে, নিকৃষ্ট জাত হিসেবে বিবেচনা করতে। এসব শাসক পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা এখন চেষ্টা চালায় বাঙালির গৌরবের দিনক্ষণগুলো ধোঁয়াচ্ছন্ন করে দিতে। সেদিন যেমন বাংলার মানুষের বীরত্বগাথাকে আড়াল করতে চেয়েছিল আর্যরা, তেমনি ৭ই মার্চের ভাষণের মহিমা ভিন্ন খাতে বইয়ে দেওয়ার কসরত কম হয়নি এ দেশের রাজনীতিতে।
বাংলার ইতিহাসে যেসব গৌরবগাথা প্রতীক হিসেবে সংযোজিত হয়েছে, ৭ই মার্চের ভাষণকে তা থেকে বিযুক্ত করার উপায় নেই। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সাধারণ সূত্র বলবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। অন্যদিকে ৭ই মার্চের ভাষণটিও হঠাৎ কোনো বিস্ফোরণ ছিল না। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতাই জন্ম দিয়েছিল ৭ই মার্চের।
বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের মুখে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানের কথিত লৌহমানব আইয়ুব খান। সামরিকপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাঁকে। উত্তপ্ত অবস্থা সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট কাটেনি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই আন্দোলন সুনির্দিষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে রূপলাভ করে। আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয় বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। এ সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের একমাত্র চাওয়া ছিল স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এই অঞ্চল নিজেদের মতো করে পরিচালনা করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানায়। কিন্তু এই সমর্থন যে এমন সর্বপ্লাবী হবে এটি হয়তো কেউ ভাবতে পারেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা বঙ্গবন্ধুকে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতায় এনে দাঁড় করাল। যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র বাঙালিকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল, তাদের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের শাসনভার ছেড়ে দেওয়া সহজ ছিল না। তাই ষড়যন্ত্রের পথেই হাঁটতে থাকে তারা। এই ষড়যন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো।
নির্বাচনের ফল ভুট্টোকে হতাশ করেছিল। তিনি ভাবেননি এতটা জনসমর্থন পাবে আওয়ামী লীগ। তাঁর ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হলেও বিভিন্ন দলের সঙ্গে কোয়ালিশন করে তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেল নির্বাচনের ফলে। ফল ঘোষিত হওয়ার পর সুর পাল্টে গেল ভুট্টোর। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে নয়—অনেকটা গায়ের জোরেই বলতে থাকলেন তাঁর দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেই কাজ চালানো সম্ভব হবে না। ভুট্টো চেয়েছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার তাঁর ও শেখ মুজিবের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাক। তিনি বোঝাতে চাইলেন পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ হচ্ছে পাকিস্তানের ক্ষমতার উৎসস্থল। আর এই প্রদেশে ভুট্টোর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু নিজ লক্ষ্যে অর্থাৎ ছয় দফার দাবিতে অটল রইলেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ৭ই মার্চের ভাষণের ক্ষণে প্রবেশ করার আগে এই পটভূমিকে অবশ্যই ধারণ করতে হবে।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি। এই দিন শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু একটি দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন।
এর পর থেকে দ্রুত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানি শাসকচক্র এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ভাবিয়ে তোলে। পরবর্তী সময়ে নীতিনির্ধারণের জন্য ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার মধ্যে গোপন শলাপরামর্শ চলতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান ১১ জানুয়ারি ঢাকা আসেন। এখানে তিন দিন অবস্থানকালে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কয়েকজন নেতা এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে এবং শেখ মুজিব দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়, এগুলো এক ধরনের চাতুরি ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ইয়াহিয়া খান ১৭ জানুয়ারি ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে ঢাকায় রাখা আশ্বাসের কথা এড়িয়ে যান। এই সূত্রেই ভুট্টো ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এই আলোচনা নিষ্ফল ছিল। আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। ভুট্টোর পরিকল্পনা ছিল নির্বাচনী ফলাফলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করার জন্য ঝামেলা তৈরি করা। এই সূত্রে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই একটি ভয়ানক অঘটন ঘটানো হলো। দুজন কাশ্মীরি যুবক ৩০ জানুয়ারি একটি ভারতীয় যাত্রীবাহী বিমান হাইজ্যাক করে লাহোরে অবতরণ করায়। পরে ৩২ জন যাত্রী এবং চারজন ক্রুসহ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু যে ঝামেলা তৈরি করার ইচ্ছা ছিল, ভারত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে তা এড়াতে পেরেছিল।
এই সময় থেকেই ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর কূটচাল চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ৩ মার্চ বুধবার সকাল ৯টায় ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকার কথা বলা হয়। অধিবেশন সামনে রেখে ১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের নেতা নির্বাচন করে। আর সহকারী নেতা নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ অবস্থায় ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিণ্ডিতে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো গোপন বৈঠকে বসেন। এর সূত্রেই প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে দেন। এতে একটি রাজনৈতিক অরাজকতা তৈরি হয়। এই অবস্থার পথ ধরে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন।
খুব সংগত কারণেই অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে হতাশ করে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। এ অবস্থায় বাঙালিদের দমন করার জন্য ইয়াহিয়া তাঁর আস্থার মানুষ লে. জে. সাহবেজাদাকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কল-কারখানা সব জায়গার কাজ ফেলে সবাই রাস্তায় নেমে আসে। শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। সর্বস্তরের মানুষ মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসন থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন তখন থেকে স্পষ্ট হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ওপর ছাত্র-জনতার দাবি উত্থাপিত হতে থাকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য। এমন ঘোলাটে রাজনৈতিক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তাঁর নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেওয়ার লক্ষ্যে জানিয়ে দেন ৭ই মার্চ বিকেল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণসমাবেশে ভাষণ দেবেন এবং সেখানেই পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করবেন।
এভাবেই রচিত হয় ৭ই মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক পটভূমি। পৃথিবীর ইতিহাসে সংযোজিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনামূলক এক অনন্যসাধারণ প্রজ্ঞাপূর্ণ কৌশলী ভাষণ, যা কাব্যময়তার মোড়কে ছিল শৈল্পিক ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান। প্রিয় নেতার ভাষণের তাৎপর্য বুঝতে সাধারণ মানুষের কোনো অসুবিধা হয়নি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
kalerkantho
সংবাদটি সর্বমোট 228 বার পড়া হয়েছে