নূরুদ্দীন দরজী:
বাংলাদেশে প্রমত্তা পদ্মার উপর বহু আকাঙ্খিত পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। ২৫ জুন-২০২২ এর উদ্ধোধনী দিন। এ পদ্মা সেতু বাংলার আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতি ছড়াচ্ছে। এ সেতু সাহস যোযাচ্ছে বাঙালির মনে। বলে দিচ্ছে আমাদের শক্তিমত্তা,সাহসিকতা ও আত্ম মর্যাদার কথা । উপলব্ধি হচ্ছে অনেক বড় কাজ আমরা করতে পারি এবং করতে হবে। অতীত ইতিহাস বলে দেয় -একদিন আমাদের বাংলা ছিল ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমরা ছিলাম সুজলা-সুফলা। বিদেশী শোষণ আমাদের জন্য কাল হয়েছে । বাংলার সম্পদ লুটে নিয়ে বিদেশীরা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। যোগাযোগ সহ সকল ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছিলাম আমরা। মোঘল,পাঠান ও ইংরেজ আমল শেষ হলে পাকিস্তানের দুঃশাসন চেপে বসে জগদ্দল পাথর হয়ে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে আমাদের, করতে হয়েছে বজ্রকঠিন মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধে পরাজিত করতে আমাদের সকল সম্পদ তারা লুট করেই শান্ত হয়নি,জ্বালিয়ে দিয়েছে ,পুড়িয়ে ফেলেছে। ধ্বংশ করে ফেলেছে আমাদের সব রাস্তাঘাট,ব্রীজ কালর্ভাট। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের প্রতিহত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ বাধ্য হয়েই ভেঙে ফেলেছিল অনেক ব্রীজ কালভার্ট। আর এ কারণেই স্বাধীনতার উষালগ্নে এ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুই ছিলনা। আত্ম নির্ভরশীল হতে নতুনের প্রতীক্ষায় আমাদের হাটতে হয় বহুদূর।
– আমাদের তৎকালীন অর্থনৈতিক বিবেচনায় পদ্মা সেতু নির্মাণের মত কাজ ছিল বড়ই কঠিন। কিন্তু তার পরও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি মাথায় নিয়েছিলেন। তিনি চিন্তা করতে থাকেন কিভাবে সেতু নির্মাণ করা যায়। ১৯৯৬ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই করে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালে পদ্মার উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্ৰহন করেন। তখন এডিবি এবং বিশ্বব্যাংক সহায়তায় হাত বাড়ায়। কিন্ত নির্মাণে গতি আসার আগেই তাঁকে পড়তে হয় গভীর ষড়যন্ত্রে । দূর্ণীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ বন্ধ হয়ে যেতে বসে।
কিন্তু না! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দমে যাওয়ার পাত্রী নন। তিনি বজ্র কন্ঠে ঘোষনা দিলেন-“নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতু করবো আমরা,। তাঁর এ ঘোষনায় বাংলার মানুষ আশায় বুক বাধেঁ, তাঁদের অন্তরে সেতু নির্মানের নতুন স্বপ্ন ও আশা জেগে উঠে । শুরু হয় নির্মাণ কাজ। সেদিন শেখ হাসিনার দৃঢ়তার প্রতীকই আজ আমাদের সুদৃশ্যমান পদ্মা সেতু।
আমরা জানি উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাত ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুল উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ উন্নয়নের মূল স্রোতধারা থেকে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ধন্য হাতের ধন্য ছোঁয়ায় পদ্মার উপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের বিশাল সেতু দেখে সমগ্ৰ বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাবাসী আনন্দে আজ আত্মহারা। তাঁদের চোখে রঙিন স্বপ্ন, মুখে উজ্জ্বল হাসি। ষড়যন্ত্রকারীদের যড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে পদ্মা সেতু এখন দেশের মানুষের বন্ধু হয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকাররীরা ভেবেছিল এ সেতু নির্মিত হলে দেশ ও দেশের মানুষ এগিয়ে যাবে, দাবাইয়া রাখা যাবেনা। তাই তারা কালিমা লেপনের চেষ্টা করে। কিন্ত দুঃসহ ঐ ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অদম্য মনোবল এবং অসীম সাহসিকতা হয়ে দাড়াঁয় এক মাইলফলক ও আর্শীবাদ। বাঙালিরা তাঁর থেকে শিখে নেয় বিপদে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়।
হিমালয় হতে সৃষ্ট গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। হিন্দু মতে- পদ্মা দেবী লক্ষীর অপর নাম। পদ্মা গোয়ালন্দে এসে গঙ্গা ও যমুনার মিলিত প্রবাহের রুপ নিয়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে। এ ধারা চাঁদপুর হয়ে বঙোপসাগরে পড়ে বিশ্বের জলধারার সাথে মিশে গেছে। পদ্মার উপশাখা,শাখা ও প্রশাখা নদীগুলো বিভিন্ন নামে দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত। কোন কোন জায়গায় শাখা নদীর উপর সেতু ও নির্মিত হয়েছে। হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে ব্রীজ ও লালন শাহ সেতুর মত পদ্মার উপর কিছু সেতু থাকলে ও মাওয়ায় পদ্মার সেতুর সাদৃশ্য কোন সেতু বিশ্বে আর কোথাও নেই। মাওয়ায় পদ্মা সেতু বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সেতু।
আমরা জানি পদ্মা নদীর তীর ভেঙে ভেঙে অনেক জায়গায় বহু গ্ৰাম, নগর সভ্যতা বিলিন হয়ে গেছে। এ জন্য কাজী নজরুলের কন্ঠে,”পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যারে, আবদুল লতিফের,”সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাইসহ অনেক বিয়োগান্তক গান গীত হয়েছে। আবার কোথাও বিস্তীর্ণ চর জেগে বাঙালি মনে আশার সঞ্চার ও করেছে। তাই আমরা গাই, এই পদ্মা,এই মেঘনা,যমুনা সুরমা নদী তটে/ আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়/কত আনন্দ বেদনা,মিলন বিরহ সংকটে,। আকাশ মাহমুদের বিখ্যাত গান,ওরে দেখে যা বিশ্ব/আমার বাংলাদেশের দৃশ্য/পদ্মা সেতু বানাইছে শেখ হাসিনায়, শুনে আমরা পুলকিত হই।
পদ্মা সেতু একটি বহুমুখি দ্বিতল সেতু। সেতুর উপরের অংশে চলাচল করছে যানবাহন অর্থাৎ বাস ট্রাক গাড়ি,লরী ইত্যাদি। অন্যদিকে নিচের অংশ দিয়ে রেল লাইন। এ সেতুর রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিকাল ফাইবার স্থানান্তরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেতু দিয়ে। সেতুর এপার ওপারের মানুষদের নদী পারাপারের যে দুঃস্বপ্ন ছিল তা আজ দূরিভূত হয়েছে। দক্ষিণ পারের মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এ হাসির ছোঁয়া প্রতিটি বাঙালির প্রাণে-মনে।
মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে। প্রতিটি ঘরে আনন্দ বইছে। তাঁরা তাঁদের উৎসন্ন শাকসব্জি, ফল মূল আনায়াসে পরিবহন করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিবে। অন্যান্য এলাকার সাশ্রয়ী মূল্যের দ্রব্যাদি ও পাবে অতি সহজে। সমগ্ৰ দেশের সাথে মিলন সেতুবন্ধন রচিত হবে। আমাদের দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পারে। বিদেশের উপন নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমে আসবে। জাতীয় প্রবৃত্তি বেড়ে উঠবে। আমাদের অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যাবে। পদ্মার ওপারে গড়ে উঠবে কলকারখানা, গড়ে উঠবে শিল্পাঞ্চল। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে আমরা হবো স্বয়ম্ভর। মাদারীপুর থেকে পায়রা সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বহুবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা। কুয়াকাটা সমুদ্র সিকত পাবে নব জাগরণ। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে। জাপানের মত দেশসহ ইতিমধ্যে অনেক দেশই বিনিয়োগে আগ্ৰহ দেখাচ্ছে। সেতুর লাইটিংসহ অন্যান্য শোভাবর্ধন কারী স্থাপনায় নয়ন জুড়িয়ে যায়। আকৃষ্ট করছে পর্যটকদের যার শুরু হয়ে গেছে আর ও আগে থেকেই।
পদ্মা নদীকে ঘিরে লিখছি বলে অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতি ও মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। পদ্মা নদী তীরবর্তী মুন্সিগঞ্জ জেলায় সুদীর্ঘ ১৫ বছর চাকরি করেছি। গিয়েছি নানাকাজে পদ্মার পারে, করেছি পিকনিকসহ অনেক আনন্দ। তীর ঘেঁষা স্কুল পরিদর্শন সহ পদ্মার ঢেউয়ে বিলিন হয়ে যাওয়া অনেক স্কুল রক্ষার্থে নিয়েছি নানা পদক্ষেপ। সুখ-দুঃখে পদ্মাপারের মানুষের সাথী হয়েছি। সেসব আজ যেন জাগ্ৰত স্মৃতির প্রতিরুপ।
২০১৫ হতে ২২২২ সাল। ঘড়ির কাটা তাল মিলিয়ে সেকেন্ড,মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস হতে হতে ৭ বছর পেরিয়ে সম্মুখে আসে। আমাদের সক্ষমতায় পদ্মা সেতু উদ্ধোধন হয় ২৫ জুন। বাঙালি জাতিকে শতাব্দী হতে শতাব্দী পর্যন্ত দমিয়ে রাখা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে এসেছি বলে অনেক বিশ্ব মুরুব্বি ও তাদের পেতাত্মারা আমাদের ভয় দেখাতো। বলতো,”বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি,। এ সময়ে যখনই আমাদের কোন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে-তারা তামাশা করে বলতো,দুর্ভিক্ষে অত লাখ,তত লাখ বাঙালি মারা যাবে। ঐ সব কথায় বাংলার মানুষ দুঃখ পেলে ও গুরুত্ব দেয়নি বলেই তাঁদের আজ অভূতপূর্ব উন্নয়ন। সেই সব মুরুব্বিরা আজ দেখছে বাংলাদেশের বিস্ময়কর পদ্মা সেতু, দেখছে বাঙালির নিজস্ব বিশাল অর্জন। সকল চ্যালেঞ্চ প্রতিহত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত নির্দেশনায় স্বীয় অর্থে নিজস্ব শক্তি দিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রতিটি বাঙালিকে করে তুলেছে গর্বিত ও বলিয়ান। প্রমাণিত হয়েছে আমরা যে কোন বড় কাজ করতে পারি। বাঙালি জাতিকে এগিয়ে চলার দীপ্ত অংগীকারে উদ্ধুদ্ধ করেছে পদ্মা সেতু। ইশারা দিয়ে বলছে-আমাদের বহু কাজ আমাদেরকেই করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে বাংলার হারানো গৌরব।
লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও) ও উপদেষ্টা, দৈনিক নরসিংদীর নবকণ্ঠ
সংবাদটি সর্বমোট 228 বার পড়া হয়েছে