পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধদের নানা উৎসব

নূরুদ্দীন দরজী:

চাঁদের আলো ষোল কলায় পূর্ণ হলে পূর্ণিমা তিথি হয়। পূর্ণিমা সকল ধর্মের মানুষের অতি প্রিয়। তবে এ তিথি বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের নিকট যেন অধিক প্রিয়। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক মহামতি গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের ও বেশি সময় আগে এক পূর্ণিমা তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়- এ তিথিতে তিনি বোধিলাভ ও মৃত্যুবরণ ও করেছিলেন।

তাই এ তিথিকে বলা হয় ‘বৌদ্ধ পূর্ণিমা।’ আবার বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ ও মৃত্যু বৈশাখী পূর্ণিমায় হয়েছিল বলে একে বৈশাখী পূর্ণিমা ও বলা হয়। গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম ও এ ধর্মের মানুষের জীবনাচরণে বিভিন্ন পূর্ণিমা তিথি যথেষ্ট প্রভাব ফেলে থাকে ।

তাই বছরের বার মাসে বারটি পূর্ণিমাতেই বৌদ্ধদের নানা রকম উপাখ্যান রয়েছে। স্পট করে বলতে গেলে বার মাসে বার পূর্ণিমার ও অধিক। আর বার মাস‌ ওয়ারী পূর্ণিমা হলো যেমন: জানুয়ারি-পৌষী পূর্ণিমা, ফেব্রুয়ারি-মাঘী পূর্ণিমা, মার্চ দৌল পূর্ণিমা/গৌরী বা ফাল্গুনি পূর্ণিমা, এপ্রিলে- চৈত্র পূর্ণিমা, মে মাসে বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা,জুনে জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমা, জুলাই গুরূ পূর্ণিমা,আগষ্টে নারালী বা রাখী পূর্ণিমা, সেপ্টেম্বরে – ভাদ্রপদ পূর্ণিমা, অক্টোবর-কোজাগিরী বা শারদ পূর্ণিমা, নভেম্বরে -কার্তিকী বা রাস পূর্ণিমা এবং ডিসেম্বরে অগ্ৰহায়ণ পূর্ণিমা।

যখন আমাদের পৃথিবী চন্দ্র ও সূর্যের ঠিক মধ্যখানে থাকে তখন‌ই পূর্ণিমা হয়। আর তখন অবস্থানটি ১৮০ ডিগ্রি হয়ে এক পাশ আলোকিত করে বলেই পূর্ণিমা। ২৯.৫ দিন পর পর একবার পূর্ণিমা আসে। বিভিন্ন গ্ৰহের যেমন নানাবিধ শুভ অশুভ দিক আছে পূর্ণিমাতে ও তাই।

তবে চন্দ্রর প্রভাব অন্যান্য গ্ৰহের চেয়ে বেশি। মানুষের মন মানসিকতায়,ভালো মন্দে থাকার জন্য চন্দ্র প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বৌদ্ধ ধর্ম মতে চাঁদের এমন প্রভাব কেন্দ্রিক দিকগুলো‌র পূর্ণিমা তিথি বিভিন্ন ধর্মীয় উপখ্যানে পরিণত হয়েছে।

সবচেয়ে বড় তিথি হচ্ছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা। আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে বুদ্ধ মাতৃ গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। আবার এ পূর্ণিমাতেই তিনি গৃহ ত্যাগ করে ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন। প্রবারণা পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধরা বর্ষাবাস ব্রত ভঙ্গ করেন। মাঘী পূর্ণিমাকে তারা মহাপরিনির্বাণ দিবস ঘোষনা করেছেন। শ্রাবণী পূর্ণিমাতে বৌদ্ধ সঙ্গীত বা ধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে গৌতম বুদ্ধ তাঁর পিতা রাজা শুদ্ধোদনকে ধর্মে দিক্ষা দিয়েছিলেন। মধু পূর্ণিমায় একটি বানর মধু দান করে বুদ্ধের সেবা করেছিলো। এমনিভাবে প্রতিটি পূর্ণিমাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে অতি প্রিয় যা তাঁরা পালন করে করে থাকেন অতিশয় শ্রদ্ধায় ভরে।

সাধারণ ভাবে বলতে গেলে পূর্ণিমায় চাঁদের আলোতে জোসনা প্রবল থাকে বলে সবকিছুই মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠে। এ আলোতে রাতের অন্ধকার দূর হয় ও এতে কোন তাপ থাকেনা। এ আলোতে বৌদ্ধগণ স্নাত হয়ে আদর্শ মানুষ রুপে গড়ে উঠতে চেষ্টা করেন। এ আলোতেই তারা পুণ্য অর্জন করেন।

পৃথিবীতে চাঁদের আলো বা জোছনার চেয়ে সুন্দর আর ও কিছু আছে বলে মনে করা হয়না। অবশ্য কবির কল্পনা চাঁদকে অতিক্রম করার ধৃষ্টতা দেখায়। বস্তুগত অনেক দিক বিশেষ করে কবিগণের প্রেয়সীরা চাঁদের চেয়ে ও সুন্দর। কবি নজরুল তো চাঁদের চেয়ে ও সুদূর তারা থেকে তারাফুল এনে তাঁর প্রিয়ার খোঁপাতে পরাতে চেয়েছেন। অনেক কবির আবার মাটির ঘরে জেগে উঠে চাঁদ। তবে বাস্তবে চাঁদের চেয়ে সুন্দর এমন কিছু এখনো আবিস্কৃত হয়েছে কেউ বলেন না।

চাঁদের নিজস্ব আলো নেই। সূর্যের আলোতেই চাঁদ আলোকিত হয় যা একটি মহা সত্য। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো কখনো লুকানো যায় না- যেমন লুকানো যায় না সূর্য আর সত্যকে । এ সব বিচার করতে হবে সত্য দিয়ে। কারণ সত্য যে চাঁদ ও সূর্যের চেয়ে ও বড়। বৌদ্ধ ধর্ম মতে সৃষ্টির লগ্ন থেকে আজ অবধি পৃথিবীতে গৌতম বুদ্ধসহ ২৮ জন বুদ্ধের আর্বিভাব হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের ধর্মীয় সময় পাঁচ হাজার বছর।

ইতিমধ্যে আড়াই হাজার বছরের ও বেশি সময় চলে গেছে। বাকি আড়াই হাজার বছর শেষ হলে আর্যমিত্র নামের বুদ্ধের আগমন ঘটবে বলে তাঁদের বিশ্বাস। গৌতম বুদ্ধের ধর্মের ত্রিশরণ মন্ত্র বা বিশ্বাস হচ্ছে “-বুদ্ধং শরনং গচ্ছামী, ধর্মং শরনং গচ্ছামী এবং সঙ্ঘং শরনং গচ্ছামী,। মহামতি বুদ্ধ প্রচার করে গেছেন অহিংস বাণী। তাঁর ধর্ম‌মত পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখে থাকবে শান্তিতে থাকবে। সকল হিংসা, হানাহানি ও অশুভতা হোক দূর। পূর্ণিমার আলোয় স্নাত হয়ে সকল প্রাণীর বসবাসে এ ধরণী হয়ে উঠুক আরও পুত ও পবিত্র।

লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)

সংবাদটি সর্বমোট 297 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *