মৃত্যুর সিঁড়ি বেয়ে জীবনের পথে

 নূরুদ্দীন দরজী:

বাসনা বেগম কীটনাশক বিষ পান করে মরতে বসেছে । তার জীবনের সকল কামনা বাসনা ত্যাগ করে বেছে নিয়েছে মরণকে। এ জীবন বাসনা বেগম আর রাখবেন না। যাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল সে স্বামীর তার প্রতি নিদারুণ অবহেলা ও অনাদর তাকে এ পথে যেতে বাধ্য করেছে। জীবনে মরণে চির সাথী স্বামীই যদি তাকে ভাল না বাসে কি লাভ জীবন রেখে? বাসনার এমন মরণ দশায় সবাই তাকে নিয়ে মহা বিপদে পড়েছে।কান্নাকাটি সারা বাড়িতে। নানাজনের নানা কথা। তার ৩ বছরের ছোট একটি ছেলে অঝোরে কাঁদছে মার জন্য। আত্মীয়স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই দুঃখ করছে। কেউ কেউ আবার মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ কেন সে এ কাজ করলো? এমন কেন হবে। এটিতো হ‌ওয়ার কথা নয়। তারাতো দেখছিলাম ভাল‌ই, সংসার সুখেই চলছিলো। তারাতো জানি সুখি দম্পতি। এমন সুখের অন্তরালে কীটনাশক মরণ হয়ে দেখা দিবে বিশ্বাস করা যায়না। বাসনার জীবনের আশা শেষ চিন্তা করেও দুএকজনের পরামর্শে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বলছিলাম একজন মানুষ বাসনার আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার কথা। নিজের জীবন নিজেই শেষ করে ফেলাই আত্মহত্যা। প্রায়ই এমন সব খবর আমাদের সমাজে শুনতে হয়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই এ পথে পা বাড়ায়। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা একটু বেশি। কীটনাশক পান করে, গলায় দড়ি দিয়ে, উত্তাল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে,চলন্ত ট্রেনের/বাসের নিচে ঝাঁপ দিয়ে,শরীরে আগুন এবং অস্ত্র দিয়ে নিজেকে আঘাত করার মত নানা পথে মরণকে বেছে নেয়। তারা একবার ও ভাবেনা এ পথতো মোটেও সঠিক নয়, কাম্য নয়। আমরা জানি মানুষ স্বভাবতই রুপময় এ পৃথিবীকে ভালবাসে। ভালবাসে জীবনকে। একদিন নিশ্চিত মৃত্যু হবে জেনেও কেউ মৃত্যু কামনা করেনা। জীবনের জন্য মানুষের গভীর মমত্ববোধ রয়েছে। কঠিন প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষ কেউ মরতে চায়না। রবীন্দ্রনাথতো বলেছেন,মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর এ ভুবনে’। বিশ্বব্যাপি বর্তমান নানা রোগ-শোক ও ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি মানুষ এমন কি বয়োবৃদ্ধরা ও দেখছি কতনা সর্তক। বেঁচে থাকতে হবে যেভাবেই হোক। সুইস লেখক কুবলার মস তাঁর বিখ্যাত,-On Death And Dying’ব‌ইতে প্রায় ৪০০ মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে গবেষণা করে যে উত্তর পেয়েছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্মরুপ। তাঁর গবেষণায় মৃত্যু পথযাত্রীদের ৫টি প্রশ্ন করে যে উত্তর পাওয়া গেছে তা হচ্ছে , তাদের উত্তরে এসেছে,(ক) মৃত্যু !এমন হতে পারেনা,(খ) সেটি আমি ন‌ই,(গ) আমার বিষয়ে ডাক্তার কোথাও ভুল করছেন,(ঘ) বিক্ষুব্ধ প্রশ্ন -আমি কেন? এবং সর্বশেষ(ঙ) কিছু না বলে চুপ হয়ে যাওয়া । তার পর‌ও কেন আত্মহত্যা? পৃথিবীতে প্রায় ৪২০০টি ধর্ম রয়েছে। কোন ধর্মেই আত্মহত্যা সমর্থন করেছে বলে জানা যায়নি। ইসলাম ধর্মমতে আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়ানো নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাগ করে মানুষ এ পথে পা বাড়ায়। ইসলামের মতে রাগ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। ঈমান নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে বেইমান হ‌ওয়া। বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিণাম নিশ্চয়ই ভাল নয়। মানুষের জীবনে নানারকম সমস্যা, সংকট আসে,দেখা দেয় দুর্যোগ দুর্বিপাক এবং অনেক সময় জীবন হয়ে যায় বেদনাবিধুর। জড়া জীর্ণতা, দুঃখ-ব্যাথা, সুখের আনন্দ নিয়েই জীবন। বেঁচে থাকতে পারাই জীবন। মৃত্যু জীবনের পরিসমাপ্তি রেখা টেনে আনে। মহান স্রষ্টার সৃষ্ট মহাবিশ্ব এবং মহাকালের বিশালতার হিসেবে একজন মানুষের জীবনের ব্যাপ্তি এমনিতেই অতি নগন্য। দ্রুত সমাপ্ত হয়ে যাওয়া সংক্ষিপ্ত জীবনকে আবার কেন নিজ হাতে আঘাত করা? কেন শেষ করে দেওয়া? হয়তো বা সহযাত্রী কেউ তার মনের সংকীর্ণতা,কুমানসিকতা, হিংসা, জিঘাংসা,বৈরীতা এবং অবহেলা আপনার চিত্তকে মলিন করে দিতে পারে। কিন্তু সবার মনে রাখা উচিত এগুলো বেশি সময় স্থায়ী হয়না। পৃথিবীতে যেমন কোন কিছুই স্থায়ী নয় -তদ্রুপ কোন সমস্যা ও চিরদিন থাকেনা। জড়া, দুঃখ, ব্যাথা ও বিষন্নতা মনে এসে বাসা বাঁধে ঠিক‌ই -কিন্তু সে বাসা বেশি দিন স্থায়ী হয়না, ভেঙে যায়, সরে যায় বা খুব অনেক হলে স্মৃতির আয়নায় আসা যাওয়া করে হয়তো বা মাঝে মধ্যে । যদি এগুলো স্থায়ী হতো তবে মানুষ বাঁচতে পারতো না। সুতরাং আত্মহত্যার পূর্বে ভাবতে হবে -যে কারণে আত্মহত্যা সে কারণে কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জীবন দেননি। সকল প্রাণীর‌ই জীবন মরণের মালিক মহান করুনাময়। তিনি তেমন জীবন দেন মৃত্যু ও দেন। এ ছাড়া আমাকে জন্ম দিতে, লালন-পালন করে বড় করতে আমার মা’র অনেক কষ্ট হয়েছিল। নিজের কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মা, বাবাসহ অন্যান্যকে দুঃখ কষ্ট দেওয়ার অধিকার আমার নেই। ভাবতে হবে এমন আত্মঘাতী মৃত্যূতে অনেক মানুষ‌ই কষ্ট পাবে, কাঁদবে। তার সন্তানাদি,মা, বাবা, আত্মীয়-স্বজন আকুল সায়রে ভাসতে পারে। সুতরাং আত্মহত্যার পথে কারো যাওয়া অন্যায়, অনুচিত, আমাদের সমাজে এমনো দেখতে পাই অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে পরবর্তিতে করুনাময়ের অশেষ কৃপায়, সুচিকিৎসায়, আপনজনদের সেবা শুশ্রুষায় ভাল হয়ে এখনো বেঁচে রয়েছেন। ফাঁসির দড়ির যমদূতের হাত থেকে ফিরে এসে বর্তমানে অনেকেই সুখে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করছেন। তারা একদিন যে সমস্যার কারণে নিজেই মৃত্যু পথ বেছে নিয়েছিল সে সমস্যার বিন্দুমাত্র এখন আর নেই। পৃথিবীতে এমন ও ঘটনা আছে যে, মৃত্যুর পথ থেকে ফেরত আসা মানুষ দ্বারা বিশ্বময় অনেক মঙ্গল সাধিত হয়েছে, মানবতা উপকৃত হয়েছে। প্রবন্ধের শুরুতে যে বাসনার কথা বলেছি সে হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে এখন স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে অনেক সুখে জীবন যাপন করছে। মানুষের কেবলই ভাবতে হবে ভালবাসার কথা। যে গৃহে , পরিবারে ও সমাজে ভালবাসা আছে, সুন্দর ব্যবহার আছে, আছে পারস্পরিক মূল্যবোধ সেখানে আত্মহত্যার মত জঘন্য ঘটনা ঘটার কথা নয়, ঘটতে পারেনা। মনীষারা বলে থাকেন,” যেখানে ভালবাসা আছে সেখানেই সুন্দর জীবন,। মানুষ ভালবাসা ছাড়া বাঁচতে পারেনা। ভালবাসা পথের ভিক্ষুককেও রাজা বানাতে পারে, শেষ পথযাত্রীকে ও ফিরিয়ে আনতে পারে।। Where There Is Love-There Is Life. লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)

সংবাদটি সর্বমোট 215 বার পড়া হয়েছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *